বিখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়েন বোনাপার্ত যথার্থই উদ্ধৃত করেছিলেন যে, “পুরো পৃথিবীকে যদি একটি রাজ্য ভাবা হয়, তবে ইস্তানবুল হবে তার রাজধানী”। কেননা, এই শহরে পা রাখা মাত্রই আপনার একবারের জন্যও মনে হবেনা যে তিনি ইস্তানবুল শহরের অপরূপ সৌন্দর্য সম্পর্কে নিছক কোন ভুল মন্তব্য করেছিলেন । মূলত পাখির চোখে অর্থাৎ উপর থেকে ৩৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে যদি আপনার একবার এই শহরকে দেখার সৌভাগ্য হয়ে থাকে তাহলে এর প্রেমে পড়া বাঞ্ছনীয়, কেননা ইস্তাম্বুল শুধুমাত্র একটি শহরই নয় বরং এক স্বপ্নের জগতও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে কিভাবে এই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব ? তবে জেনে নেই সে সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ
ইস্তানবুলের বুকে যে সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা বা ভবন এখন পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘গালাতা টাওয়ার’ বা তুর্কি ভাষায় ‘গালাতা কুলেসি’ তাদের মধ্যে অন্যতম, যাকে সাধারণ জনগণের কাছে ‘ইস্তানবুলের চোখ’ হিসাবে নতুন করে পরিচিতি এনে দিয়েছে, কেননা ইস্তানবুল শহরের অধিকাংশ দৃশ্যই ৬৬ মিটার-উচ্চতা সম্পন্ন (২০৬ ফুট লম্বা) এই টাওয়ারের বারান্দা দিয়ে অবলোকন করা সম্ভব। কিন্তু এই টাওয়ারের নির্মাণকাল বা এই বিষয় সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক সঠিক কোন তথ্য আজ পর্যন্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সাধারণ জনগণের মাঝে দুটি আনুমানিক ধারণা বেশ প্রচলিত রয়েছে।
প্রথমত; বাইজেন্টিয়ান সাম্রাজ্যের রাজা আনাস্তাসিওস প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি ৫২৮সালে একটি লাইট হাউস বা বাতিঘর হিসাবে এই গালাতা টাওয়ারটি নির্মান করেছিলেন। আর দ্বিতীয়ত হলো, ১৩৪৮ সালে যখন জেনোজরা কন্সটন্টিনোপলে এসেছিলো, তখন গালাতা ওয়ালগুলি শহরের ভিতরের অংশের সুরক্ষার জন্য নির্মাণ করেন । আর সেই সাথে গালাটা টাওয়ারটিকেও দেয়ালের উপরের অংশের দেখভাল করতে নজরদারির টাওয়ার হিসাবে নির্মান করেছিল।
গালাতা টাওয়ারটিকে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমনঃ জেনোইজরা বাইজেন্টাইনদের সাথে বাণিজ্যে জড়িত ছিল এবং টাওয়ারটি তখন গোল্ডেন হর্নের উপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল। এরপর অটোমানরা যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করে, তখন তারা এটিকে একটি কারাগারে রূপান্তরিত করে এবং ১৬’শ শতাব্দীতে কাসিমপাশা শিপইয়ার্ডগুলিতে নিযুক্ত খ্রিস্টান যুদ্ধবন্দীদের আশ্রয় হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এছাড়াও সুলতান তৃতীয় মুরাদের অনুমতি নিয়ে জ্যোতির্বিদ তকিয়াউদ্দীন এখানে একটি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। যদিও পরে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
যাইহোক, এই টাওয়ার নিয়ে সবচেয়ে সুপরিচিত গল্পটি হল হেজারফেন আহমেদ চেলেবির। অটোমান সাম্রাজ্যের ১৭ শতকে হেজারফেন আহমেদ চেলেবি প্রথম ‘উড়ন্ত তুর্কি’ হিসেবে পরিচয় লাভ করেন। তিনি ১৬৩৮ সালে কাঠের তৈরি ঈগলের ডানা পিঠে বেধে গালাতা টাওয়ার থেকে উড়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার (৪ মাইল) দূরে অবস্থিত বসফরাস প্রণালীর ইউরোপিয়ান অংশ হতে এশিয়ান অংশ উস্কুদারের দোয়ানজিলার মহল্লায় অবতরণ করেন। তবে এই উড্ডয়নের আগে তিনি বাতাসের গতিবিধি নিয়ে বেশ গবেষণা করেছিলেন এবং নিজের জন্য পাখির ডানা নকল করেছিলেন। এই দর্শনীয় কৃতিত্বের কারণে, সুলতান মুরাদ খান লোকটির প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন এবং পরবর্তীতে ব্যাগভর্তি সোনা উপহার দিয়ে তাকে আলজেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। এরপর ১৭১৪ সালে প্রথম আধুনিক অটোমান ফায়ার ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর, এর উচ্চতা এবং নিখুঁত অবস্থানের কারণে এটি একটি ফায়ার ডিটেকশন টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। এই টাওয়ারের এত এত সফলতার গল্প ছাড়াও ১৯৭৩ সালে একটি দুঃখজনক ঘটনারও সাক্ষী হতে হয়েছিল। বিখ্যাত তুর্কি কবি উমিত ইয়াসার ওউযজানের ১৫ বছর বয়সী পুত্র ভেদাত এখানে আত্মহত্যা করেছিলেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত কবি তাঁর পুত্রের স্মরণে একটি উপাখ্যান লিখেছিলেন।
এছাড়াও ওই সময়কার লোকেরা একটি অদ্ভুত খেলার জন্য টাওয়ারটিকে ব্যবহার করত। তারা টাওয়ারের উপরে আংটার সাথে দড়ি বেঁধে দড়ি বেয়ে নিচে নামতো। পরে আবার সেই দড়ি বেয়ে টাওয়ারের উপরে উঠতো। দড়ি আরোহনের এই খেলায় নিয়মিত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। মাঝে মাঝে, মেভলেভি দরবেশদের (মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর অনুসারীদের মেভলেভি বলা হয়ে থাকে) আদেশে তাদের সেমা (মেভলেভি তারিকাতের জিকিরের আয়োজন) অনুষ্ঠানের জন্যও টাওয়ারটিকে ব্যবহার করত। বেশ অনেকদিন যাবৎ পরিত্যাক্ত থাকার পরে গালাতা টাওয়ারটি ১৯৯০ সালে শেষের দিকে পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং পর্যটন আকর্ষণ হিসাবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
তবে বর্তমানে, ২০৬ ফুট (৬৬ মিটার) উচ্চতা বিশিষ্ট টাওয়ারটি শুধুমাত্র একটি পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে লোকেরা টাওয়ারের বারান্দা থেকে ইস্তাম্বুলের অত্যাশ্চর্য ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখতে উপরের অংশে যাওয়ার জন্য নিচে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করে। তবে ভিতরে একটি লিফট আছে যার মাধ্যমে পর্যটকরা সপ্তম তলা পর্যন্ত যেতে পারেন, কিন্তু বাকি দুই তালা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
বের হওয়ার সময় গালাতা টাওয়ার মিউজিয়ামেও চোখ রাখতে পারেন। যাদুঘরটি চারটি তলায় মঞ্চস্থ করা হয়েছে যেখানে ইস্তাম্বুলের ইতিহাস এবং টাওয়ার সহ শহরের প্রাচীরের গল্প কভার করে এমন বিভিন্ন বিষয় সংরক্ষণ করা হয়েছে।
গালাতা টাওয়ারের প্রবেশ ফি: ৬৫০ লিরা। ১৮ বছর বয়সের নিচে শিশুদের জন্য প্রবেশ ফি ফ্রি ।
প্রবেশের সময়সীমাঃ এটি প্রতিদিন সকাল ৮:৫০ থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। নৈশ্য ভোজন এর উদ্দেশ্যে গালাতা টাওয়ারের শীর্ষে বসে শহরের রাতের প্যানোরামা উপভোগ করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পূর্বে আপনার আসন সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক।