বালা লক্ষিন্দর, বিষে জরজর,
দেখি বেহুলা সুন্দরী।
মুখে পড়ে লাল, অঙ্গ হইল কাল
মনেতে বিষাদ করি ।।
বেহুলা বলে হায়, করি কি উপায়,
শুনো হে বানিয়ান্নোত;
অদ্ভুত কথন, বাসরে মরণ,
দেখি লাগে চমকিত ।।
–কবি ক্ষেমানন্দ দাশ
বেহুলার বিলাপ সম্বলিত উক্ত পালা প্রাচীন বাংলার মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র বেহুলা ও লক্ষিন্দরের লোহার বাসর ঘর ও সাপে কাটার ঘটনাকে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কখনো কি ভেবেছেন অনুরূপ ঘটনা বহুল কোন স্থান পৃথিবীর অন্য কোথাও বিদ্যমান আছে? হ্যাঁ ! তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের উস্কুদার সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত থেকে ২০০ মিটার দূরে বসফরাস প্রণালীর মধ্যে অবস্থিত ‘কিজ কুলেসি’ খ্যাত এমনই এক ঘটনার সাক্ষী। এটি ইস্তাম্বুল এবং তুরস্কের স্থাপত্যের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপনাগুলির মধ্যে একটি। এটি ‘মেইডেনস টাওয়ার’, ‘টাওয়ার অফ লিয়েন্ড্রোস’ কিংবা বাংলায় ‘বসফরাস টাওয়ার’ নামেও পরিচিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বাইজেন্টাইন সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের (৫৭৮-৫৮২) একটি খুব সুন্দরী কন্যা ছিল। একজন জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয় কন্যার তার ১৮ তম জন্মদিনে একটি বিষধর সাপের দংশনে মৃত্যু হবে। এটি শোনার পর কন্যাকে রক্ষা করার প্রয়াসে সম্রাট বসফরাসের মাঝে এই টাওয়ার তৈরি করেছিলেন এবং তার কাছে কোন সাপ যেন পৌঁছাতে না পারে সেজন্য সেখানে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যার একমাত্র নিয়মিত পরিদর্শক ছিলেন তার বাবা। রাজকন্যার ১৮ তম জন্মদিনে সম্রাট তাকে উপহার হিসাবে দেয়ার জন্য বাহির থেকে একটি আঙ্গুর ফলের ঝুড়ি এনেছিলেন এবং তিনি আনন্দিত ছিলেন যে তিনি জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীটি ব্যর্থ প্রমান করতে পেরেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, যখন রাজা কন্যার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তখন আঙ্গুর ফলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি সাপ এসে রাজকন্যাকে দংশন করে এবং সে তার বাবার বাহুতেই মৃত্যুবরণ করে, ঠিক যেমন জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। তাই এর নাম মেইডেন টাওয়ার রাখা হয়।
অন্য এক পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, ‘লিজেন্ড অফ লিয়েন্ড্রোস অ্যান্ড হিরো’ লিখেছেন মুসাইরোস নামে একজন কবি যিনি প্রাচীন কবি হোরোসের (তিনি প্রায় ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বসবাস করতেন) অনেক আগে বেঁচে ছিলেন। এ লেখনিতে ‘লিয়েন্ড্রোস’ ও ‘হিরো’ নামে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা ছিল। হিরো ছিল সৌন্দর্যের প্রতীক, যাকে গ্রীকরা আফ্রোডাইট এবং পশ্চিমারা ভেনাস বলে অভিহিত করত। হিরো হেলপন্টোসের ইউরোপীয় তীরে সেস্টোস নামে একটি শহরে বসবাস করত, যাকে বর্তমানে চানাক্কালে বোয়াজ বলা হয় । অন্যদিকে বসফরাসের অপর প্রান্ত অ্যাবিডোস শহরের রাজার ছেলে লিয়েন্দ্রোস প্রতিদিন রাতে অ্যাবিডোস থেকে সাগরে সাঁতার কেটে সেস্টোয়াতে প্রেমিকার (হিরো) সাথে দেখা করতে যেতেন। একদিন রাতে বরাবরের মতো হিরো একটি টর্চ জ্বালিয়ে লিয়েন্ড্রোসকে তার কাছে ডেকে পাঠায়।ঐদিন প্রবল ঝড় আসে এবং হিরো সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে, কিন্তু তার প্রেমিকের দেখা পায় না। পরদিন সকালে সমুদ্র সৈকতে ভেসে যাওয়া লিয়েন্ড্রোসের লাশ দেখে হিরো নিজেকে সামলাতে না পেরে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে । উস্কুদার টেকফুরু (হিরোর বাবা), যিনি এই করুণ পরিণতিতে খুব বিচলিত হন এবং তাদের স্মৃতিতে এই দ্বীপে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিলেন যাকে আমরা বর্তমানে কিজ কুলেসি নামে জানি । বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন ১৮১০ সালের ৩ মে তার ‘জাহাজ দ্য সালসেট’ নিয়ে দারদানেলসে এসেছিলেন এবং এই গল্পের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য বসফরাস পার হয়েছিলেন। কারণ দাবি করা হয়েছিল যে স্রোতের কারণে সাঁতার কেটে স্ট্রেইটটি অতিক্রম করা যায় না, এবং তাই গল্পটি একটি বানোয়াট। তবে অন্য আরেকজন ফরাসি লেখক, যিনি ১৮৪৫ সালে ‘বি এবং বি’ ছদ্মনামে ‘কনস্টান্টিনোপল এট লে বসফোর’ নামে একটি রচনা প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে উল্লেখিত ঘটনাটির সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
তবে যাই হোক, মেইডেনস টাওয়ারের ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর সাথে সংশ্লিষ্ট। ঐতিহাসিকদের মতে সাইজিকাসে নৌ বিজয়ের পর প্রাচীন এথেনিয়ান জেনারেল অ্যালসিবিয়াডেসের আদেশে বসফরাসে যাতায়ত করা জাহাজগুলোর জন্য এটি একটি ওয়াচ স্টেশন হয়ে উঠে। এরপর বাইজেন্টাইন সম্রাট অ্যালেক্সিয়াস কমনেনাস তখন দ্বীপে একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর এবং কাঠের টাওয়ার তৈরি করেছিলেন যা কনস্টান্টিনোপলের তথা ইস্তানবুলের ইউরোপীয় অংশের আরেকটি অনুরূপ টাওয়ারের সাথে সংযুক্ত ছিল। সেই পাথরের দেয়ালের পানির নিচের অবশিষ্ট অংশ আজও দেখা যায়। ১৪৫৩ সালে, কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের সময় টাওয়ারটি বাইজেন্টাইন গ্যারিসন হিসাবে ব্যবহৃত হতো । এর মাঝে ভূমিকম্পের কারণে টাওয়ারটি অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। পরবর্তীতে সুলতান সেলিম টাওয়ারটিকে পুনঃস্থাপন করেছেন এবং এটিকে আবার একটি ওয়াচ টাওয়ারে পরিণত করেন।
এই টাওয়ারটি সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৮৩০ সালে ইস্তাম্বুলে যখন কলেরার মহামারী দেখা দেয়, তখন টাওয়ারটি কলেরায় আক্রান্তদের জন্য কোয়ারেন্টাইন সুবিধা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কলেরা মহামারী শেষ হওয়ার সাথে সাথে টাওয়ারটি আবার ওয়াচ টাওয়ার হিসাবে তার পূর্বের কাজ পুনরায় শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৯৮ সালে জেমস বন্ড এর মুভি “দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ” এর জন্য এটিকে নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছিল। এরপর ১৭ আগস্ট ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্প এবং মারমারা সাগরে সুনামির পর এটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য টাওয়ারে স্টিল সাপোর্ট যুক্ত করা হয়।
এটি সম্প্রতি পরিচালনার জন্য একটি হোল্ডিং কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছিল এবং ২০০০ সালে পুরোপুরি পুননির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে নিচতলায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে যেখান থেকে একটি কাঠের সিঁড়ি উপরের তলায় চলে গেছে যার বিভিন্ন তলায় বিক্রয় কেন্দ্র বিদ্যমান আছে। এর চারপাশে একটি বারান্দা সহ চা খাওয়ার জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখান থেকে, যে কেউ নির্দিষ্ট দূরবীন দিয়ে উস্কুদার, বসফরাস এবং ইস্তাম্বুলের দুর্দান্ত প্যানোরামা দেখতে পারে।
প্রবেশের সময়সীমাঃ প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৭ পর্যন্ত ।
প্রবেশ মূল্য: ৫৫০ লিরা, মিউজিয়াম কার্ড ব্যবহার যোগ্য ।