আপনি কি কখনো কল্পনা করেছেন বিজ্ঞানী নিউটন যেমন একটি আপেল বাগানে বসে তার শ্রেষ্ঠ কর্ম মধ্যাকর্ষণ বল আবিষ্কার করেছিলেন ঠিক তেমনি আপনিও কোন এক মনোমুগ্ধকর সবুজ শ্যামল বাগানে বসে পৃথিবীর সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন কোন মহাদেশের শব্দের প্রতিধ্বনিকে আবিষ্কার করতে পারবেন? বিষয়টি বিভ্রান্তিকর মনে হলেও তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে অবস্থিত ‘রুমেলি ক্যাসেল’ নামক জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্রে এটি অনেকাংশে সম্ভব । কেননা, এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশকে বিভক্তকারী বসফরাস প্রণালীর পশ্চিম পার্শ্ব সংলগ্ন ইউরোপিয়ান অংশে অবস্থিত ‘রুমেলি ক্যাসেল’ তথা ‘রুমেলিহিসারি’ দুটি মহাদেশের সমগ্র সৌন্দর্যকে একই ফ্রেমে আবদ্ধ করেছে। এ যেন ইউরোপে বসে আনাদোলু তথা এশিয়ার অপরূপ দৃশ্যকে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করার মতো !
তবে রুমেলি ক্যাসেল ইস্তানবুল শহরকে যতটা সৌন্দর্যের দিক থেকে আকর্ষণীয় করেছে ঠিক ততটাই সমৃদ্ধ করেছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবেও । রুমেলি ক্যাসেল হল অটোমানদের দ্বিতীয় প্রাচীনতম দুর্গ যা ইস্তানবুলের সারিয়ার অংশে প্রায় ৫০ একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত । দূর্গের আসল নাম ‘বোয়াজকেসেন ক্যাসেল’ বাংলা ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় “গলা কাটা দূর্গ’ । এখানের “গলা” দ্বারা বসফরাস প্রণালীকে বুঝানো হয়েছে। আধুনিক রুমেলি হিসারি মানে “রোমানদের দেশের দুর্গ”, যা বাইজেন্টাইন বা ইউরোপকে বোঝায়। একইভাবে, প্রণালীর অপর পাশে এশিয়ান অংশে নির্মিত দুর্গটির নাম আনাদোলুহিসারি বা আনাতোলিয়ান দুর্গ।
তবে যাই হোক রুমেলই দুর্গটি নির্মাণের আসল উদ্দেশ্য জানা প্রয়োজন খুবই প্রয়োজন । কথিত আছে রুমেলি দুর্গেটি ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগে বসফরাসের উত্তর দিক থেকে আসা আক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে বাইজেন্টাইনদের জন্য সাহায্য আসার রাস্তা বন্ধ করতে আনাতোলিয়ান দুর্গের ঠিক উল্টোপাশে ফাতিহ সুলতান মেহমেত এর নির্দেশে ১৫ এপ্রিল, ১৪৫২ সালে নির্মান কাজ শুরু হয়েছিল। এটি নির্মানের উদ্দেশ্য ছিল ইস্তাম্বুল বিজয়ের সময় উদ্ভূত বিপদগুলি প্রতিরোধ করে তৎকালীন বাইজেন্টাইন শহর কনস্টান্টিনোপলে একটি পরিকল্পিত অটোমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা । দ্য ফোর্টেসের তথ্য অনুসারে দূর্গের মূল পরিকল্পনাটি ফাতিহ সুলতান মেহমেদ স্বয়ং নিজে করেছিলেন এবং এর নির্মান কাজে ১০০০ জন কারিগর এবং ২০০০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিয়োজিত ছিল। তবে মজাদার বিষয় এই যে মাত্র চার মাসে সমগ্র ভবনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। কাজ শুরুর পরে প্রতিটি অংশের নির্মাণের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তার উজিরদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল এবং সমুদ্রের পার্শ্বের অংশটির নির্মাণ কাজ স্বয়ং ফাতিহ সুলতান মেহমেত নিজের হাতে নিয়েছিলেন। সমুদ্র থেকে তাকালে ডানদিকে যে টাওয়ার দেখা যায় তার নির্মাণের তদারকি করেছিলেন সরুকা পাশা, বামদিকে টাওয়ার নির্মাণের জন্য জ্যানোস পাশা এবং তীরবর্তী টাওয়ার নির্মাণের জন্য হালিল পাশাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। টাওয়ার গুলির নাম উক্তপাশা গুলির নামেই নামকরণ করা হয়েছে। অবশেষে দুর্গটির নির্মাণ কাজ ৩১ ই আগস্ট ১৪৫২ সালে সম্পন্ন হয়।
সময়ের আবর্তে এ দুর্গটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে । যেমন: ১৪৫৩ সালের মে মাসে বিখ্যাত কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর উসমানীয়রা দুর্গটিকে কাস্টমস চেকপোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে এবং ১৭ শতকে একে কারাগারে পরিণত করা হয় । ইতোমধ্যে ১৫০৯ সালের ভূমিকম্পে ভবনটির একটি অংশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদিও তা অল্প সময়ের মধ্যেই মেরামত করা হয়েছিল । এর প্রায় ২৫০ বছর পর ভবনের কাঠের অংশগুলিতে একটি বড়ধরনের অগ্নিকান্ডের ফলে দূর্গের বড় একটি অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। এরপরে দুর্গটি দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়েছিল। সম্রাট তৃতীয় সেলিমের শাসন আমলে তার আদেশে এটিকে পুনরুদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রপতি সেলুল বায়ারের নির্দেশে তিন তুর্কি মহিলা স্থপতি ‘কহিদে তামের আকসেল’, ‘সেলমা এমেলার’ এবং ‘মুয়ালা আয়েবোলু আনহেগার’ মিলে দুর্গটি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করেন। দুর্গের অভ্যন্তরের কাঠের ঘরগুলি ভেঙে তা পুনরায় মেরামত করা হয়।
রুমেলি হিসারির অভ্যন্তরে এক সময়ে যাদুঘর এবং ওপেন এয়ার থিয়েটার হিসাবে ব্যবহৃত হত, তবে দূর্গের অভ্যন্তরে বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যাইহোক, কিছু বিষয় আছে যা সকলের মনে রাখা উচিত যেমন: আপনার যদি উচ্চতার ভয় থাকে, তাহলে দুর্গের দেয়াল দিয়ে হাঁটতে আপনার অসুবিধা হতে পারে। এছাড়া আপনি ৬০ সেমি চওড়া সিঁড়ি ব্যবহার করে দুর্গে ১৫ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারেন। যেহেতু খাবার এবং পানীয় নিয়ে দুর্গে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ, আবার ভিতরে খাবার বিক্রি হয় এমন কোন দোকান বা ক্যাফে নেই তাই এই বিষয়ে আপনার অগ্রিম প্রস্তুতি নেওয়া উত্তম হবে। আপনি যদি দুর্গের ভিতর থেকে উঁচু প্রাচীর বেয়ে উঠতে পারেন তাহলে সেখান থেকে বসফরাস এবং ফাতিহ সুলতান মেহমেত সেতু দেখতে পারবেন এবং ছবি তুলতে পারেন। তাছাড়া এখানে অটোমান আমলের বিভিন্ন কামানও দেখতে পাবেন।
সর্বোপরি রুমেলি ক্যাসিলির প্রতিটি কোণের প্রাকৃতিক দৃশ্য,অটোমান ইতিহাস ও ঐতিহ্য আপনার প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে সজীব, প্রাণবন্ত ও প্রফুল্ল করে তুলবে।
প্রবেশের সময়সীমাঃ গ্রীষ্মকাল সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৬ টা, শীতকাল সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত । অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন যে সোমবার যাদুঘর বন্ধ থাকে।
রুমেলি দুর্গের প্রবেশ মূল্য: ১৩০ তুর্কি লিরা। আপনি রুমেলি হিসারিতে প্রবেশের জন্য ইস্তাম্বুল মিউজিয়াম কার্ডও ব্যবহার করতে পারেন।