২০১৯ সালে চামলিজা জামি(মসজিদ) হওয়ার আগ পর্যন্ত ৪৬০ বছর ধরে থাকা তুরস্কের সবচেয়ে বড় মসজিদ ওসমানী বাদশা কানুনি সুলতান সুলায়মান কতৃক নির্মিত সুলায়মানি জামি । মসজিদটির স্থপতি মিমার সিনান। সুলায়মানি জামিকে চিনতে হলে আগে চিনতে হবে সুলতান সুলেমানকে ও মিমার সিনানকে । কে ছিল সুলতান সুলায়মান ? ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ১০ম সুলতান, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা- তিন মহাদেশের শাসনকর্তা এবং ইসলাম খলিফা ছিলেন তিনি। আপনারা হয়তো দিরিলিস আর্তুরুল ও কুরুলুস ওসমান সিরিয়ালের সাথে পরিচিত হয়ে থাকবেন। আর্তুরুল আর ওসমানের বংশধর এই সুলতান সুলায়মান। ওসমান গাজী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্টাতা আর সম্রাজ্যের ১০ম সুলতান, সুলতান সুলায়মান। আর কে এই বৃহত মসজিদের স্থপতি মিমার সিনান ? পৃথিবীর স্থাপত্য ইতিহাসে স্মরণীয় এই নাম মিমার সিনান। তার নামের মিমার অংশ টার অর্থ আসলে স্থপতি। মিমার সিনান মানে স্থপতি সিনান। ওসমানীয় সম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনি । শুরুতে তিনি ওসমানীদের বিশেষ সেনা বাহিনী ইয়েনিচেরি, পশ্চিমারা যাদেরকে জ্যানিসারি বলে চিনে সেই সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে তার স্থাপত্য জ্ঞান প্রকাশ পেলে স্থপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। ৪৮ বছর বয়সে প্রধান স্থপতির দায়িত্ব পান আর জীবদ্দশায় শুধু মসজিদই নির্মাণ করেন শতাধিক। তার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি এই সুলায়মানি জামি ।
সুলায়মানি জামি আসলে সুলায়মানি কমপ্লেক্সের একটি অংশ। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে ছোটদের জন্য মাদ্রাসা, যেটাকে বর্তমান সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে তুলনা করা যেতে পারে। আছে বর্তমান সময়ের ইউনিভার্সিটি সমপর্যায়ের ৪ টি মাদ্রাসা। একটি হাসপাতাল আরেকটি মেডিকেল ইউনিভার্সিটি। তাবহনে যেখানে মুসাফির রা ৩ দিন পর্যন্ত বিনা খরচে থাকতে পারতো। এর সাথে রয়েছে বিরাট রান্নাঘর যেটাকে ইমারেত বলা হয়। মাদ্রাসা , হাসপাতাল , তাবহনের খাবার এখানে করা হতো। হাম্মাম রয়েছে একটি। রয়েছে দারুল হাদিস (হাদিস পাঠদানের স্থান) আর দারুল কুড়া (কুরআন পাঠদানের স্থান)। আর এই বিশাল কমপ্লেক্সের কেন্দ্রবিন্দু মাত্র সাত বছরে নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা বিশাল এই মসজিদ সুলায়মানি জামি । এখন আর অবশ্য বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো নেই। কিছু দোকানপাট হয়েছে , ব্যাক্তিমালিকানায় চলে গিয়েছে । যদিও এই সবগুলোই ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান আর ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলো আইন অনুসারে কোনোভাবে ব্যক্তিমালিকানায় যায় না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিগত দশকগুলোতে এই ওয়াকফ সম্পদগুলোতে হাত বসায় অর্থলোভী মানুষেরা ।
প্রত্যেকটা স্থাপনার একটা মেয়াদকাল থাকে। আপনি একটি বাড়ি তৈরী করবেন , তখন ইঞ্জিনিয়ার আপনাকে একটা মেয়াদকাল দিবে হয় ১০০ বছর নয় ১৫০ বছর। এরকম এই সুলায়মানি জামিরও এক মেয়াদকাল দিয়েছিলো মিমার সিনান সুলতান সুলেমানকে। সেটা হলো কেয়ামতের আগপর্যন্ত। তুরস্কের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবন এই শহর ইস্তানবুলে তিনি এমন এক মসজিদ নির্মাণ করেছেন যেটা সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পেও ক্ষতির শিকার হবে না। ফাতিহ জামি , আইয়ুব সুলতান জামি এর মতো অনেক মসজিদ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে আর এগুলো পুননির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সুলায়মানি জামি কোনো ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় নাই। আসলে মিমার সিনান প্রথমে ফাউন্ডেশন পাইলিং দিয়ে এখানকার ভিত্তি মজবুত করেছে। ধারণা করা হয় একারণে মসজিদের কাজ প্রায় ২ বছর বন্ধ ছিল। সুলতান সুলায়মানের ওই সময়কার প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া সাফেভি রাষ্ট্রের সম্রাট তাহমাসব সুযোগ পায় সুলতান সুলেমানকে অপমান করার। সে অনেক সোনাদানা অলঙ্কারসহ এক পত্র পাঠায় সুলতান সুলায়মানের কাছে। পত্রে বলে যে শুনেছি অনেক বড় এক মসজিদ বানানোর কাজ হাতে নিয়েছেন কিন্তু কাজ আগাচ্ছে না। হয়তো টাকা পয়সার ঘাটতিতে পড়েছেন এজন্য এই সোনাদানাগুলো ব্যবহার করতে পারেন। সুলতান সুলায়মান কিন্তু পারতেন তার এই সম্পদ তাকে ফেরত পাঠাতে অথবা সাগরে ফেলে দিতে কিন্তু তিনি তা করেনি। কারণ এটি একটি ওয়াকফ সম্পদ। যে কারো অবদান রাখার সুযোগ আছে এটার প্রতিষ্টায়। তাই তিনি এই সম্পদ ব্যবহার করেন মসজিদের এক মিনার তৈরী করতে। সেই মিনারটার নাম তাই রাখা হয় জেভহের মিনার অর্থাৎ অলংকার মিনার। কিন্তু সেই মিনার আসলে কোনটা সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না কেউ।
মসজিদের মিনার নিয়ে আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে। মসজিদের মোট মিনার ৪ টি। যেটা প্রকাশ করে যে ইস্তানবুল জয়ী সুলতান ফাতিহ সুলতানের পর সুলতান সুলায়মান চতুর্থ সুলতান আর মিনারে আজান দেয়ার জন্য এক স্থান আছে যেটাকে বলে শেরেফে। তাকালে দেখতে পারবেন মিনারে গোল গোল বারান্দা। এই শেরেফে এর সংখ্যা রয়েছে ১০ টি। সুলতান সুলায়মানের ১০ম সুলতান হওয়ার কারণে ১০ টি শেরেফে তৈরী করেন মিমার সিনান।
মসজিদের ভেতরে ঢুকলেই আমাদের চোখে পরে ৫০ মিটার বড় বিশাল গম্বুজ। অবাক করার বিষয় হলো এতবড় গম্বুজ কিভাবে উপরে শক্ত করে দাঁড়িয়ে রেখেছে মিমার সিনান। মিমার সিনান বলেছে যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে গম্বুজ যাওয়ার সম্ভবনা আছে কিন্তু ধসে পড়বে না। চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে গম্বুজের দিকে তাকালে গম্বুজে লেখা আয়াতগুলো আমাদের বলে: তোমরা এটা দেখে বিস্মিত হয় না। মসজিদ থেকে বের হও। আসমানের দিকে তাকাও, আসল বিস্ময় তখন দেখতে পাবে। গম্বুজে লেখা রয়েছে সূরা ফাতির এর ৪১ নং আয়াত। “আল্লাহই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন, যাহাতে উহারা স্থানচ্যুত না হয়, উহারা স্থানচ্যুত হইলে তিনি ব্যতিত কে উহাদিগকে রক্ষা করিবে ? তিনি তো সহনশীল , ক্ষমা পরায়ণ।“ আর এই বিশাল গম্বুজ এর পিলারগুলোর রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। ৪ টি পিলার ৪ সভ্যতা থেকে আনা হয়েছে। একটি আনা হয়েছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে , একটি আনা হয়েছে ফিইনিশিয়া সভ্যতার বালবেক শহর থেকে , একটি আনা হয়েছে এই ইস্তানবুলেরই কিজতাসি থেকে যেটা রিপ্রেজেন্ট করে গ্রেট রোমান এম্পায়ার আরেকটি তোপকাপি থেকে যেটা রিপ্রেজেন্ট করে ইস্ট রোমান এম্পায়ার।
এই মসজিদের আরো কিছু বিশেষত্ব তুলে ধরা যাক।
বিশাল এই মসজিদে নামাজ পড়তে পারে ১০ হাজারের মতো মুসল্লি। তখনকার যুগে মাইক, লাউডস্পিকার, ইলেক্ট্রিসিটি কিছুই ছিল না। তাহলে ইমামের কিরাত , খুৎবা মুসল্লিরা কিভাবে শুনবে ? সমাধান করেন মিমার সিনান। তিনি গম্বুজের চারপাশে এবং কাঁচের বিভিন্ন স্থানে ফাঁপা কিউব স্থাপন করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও ইন্টারনাল স্ট্রাকচার এমন ভাবে করা যাতে ইমামের কণ্ঠ ১০ হাজার মুসল্লি সমানভাবে শুনতে পারে। বর্তমান সময়ে বড় বড় থিয়েটার গুলোতে এভাবে ন্যাচারাল একোস্টিক তৈরী করা হয় কিন্তু মিমার সিনান এটি তৈরি করতে সফল হয় ৪০০ বছর পূর্বে।
আরেকটি বিষয়। সেই সময়ে রাতে বর্তমান সময়ের মতো বাল্ব জ্বলতো না। এখনকার মতো ঝাড়বাতিগুলোও ছিল না, ছিল কান্দিল। যেটা আমাদের দেশের চেরাগের মতো। তেলবাতি আরকি। কিন্তু এইটা ব্যবহার করা একটি সমস্যা। কারণ এই চেরাগের ধোয়া থেকে কালির সৃষ্টি হয়। সুন্দর এই মসজিদের দেয়ালে কালির স্তরণ পরে যাবে , কুরআনের আয়াত লেখা ক্যালিগ্রাফি নষ্ট হয়ে যাবে। এরও সমাধান আছে মিমার সিনানের কাছে। মসজিদে জানালার অভাব নাই , এর সাথে অভাব নাই আলো বাতাসেরও। আর মিমার সিনান জানালাগুলো এমন এমন জায়গায় তৈরী করেছেন যাতে বাতাসের প্রবাহ তিনি কন্ট্রোল করতে পারেন। এই চেরাগ গুলো থেকে বের হওয়া ধোয়া যেখানে সেখানে যেত না। বাতাসের প্রবাহে নির্দিষ্ট এক ফোকরের ভিতরে যায় ধোঁয়াগুলো। ঐখানে রয়েছে ৩ টা গর্ত। ওই গর্তগুলোর ভিতর হয়ে যায় একটি ঘরে। যেই ঘরটির নাম ইস ওদা। ইস শব্দের অর্থ কালি আর ওদা অর্থ ঘর। ওই ঘরের দেয়ালে জমা হয় সব কালি। পরবর্তীতে ওই দেয়ালগুলো থেকে নেওয়া কালি আবার ব্যবহার করা হতো লেখার কাজে।
সমস্যা আরো একটি আছে। মাকড়সার জাল। এরকম একটা ইমারতের আনাচে কানাচে মাকড়সার জাল হবে স্বাভাবিক কিন্তু এতে সৌন্দর্য নষ্ট হবে মসজিদের। এজন্য ব্যবহার করে হয়েছে উঠ পাখির ডিম। মসজিদের ঝাড়বাতিতে এখনো আছে এগুলো। উঠ পাখির ডিম্ থাকলে সেখানে মাকড়সার জাল হয় না। কিন্তু এর কি আসলে বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা রয়েছে ? বর্তমান সময়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে উট পাখির ডিম্ মাকড়সার জাল বাঁধতে প্রায় ৫০ শতাংশ বাধা দেয়। কিন্তু ওসমানী সময়ের এই ডিমগুলোতে আরো বিশেষ কিছুর লেয়ার ব্যবহার করা হতো যার কারণে শতভাগ রোধ করা সম্ভব হতো। মাকড়সা জাল বাঁধতে পারতো না এই মসজিদে।
সুলায়মানি কমপ্লেক্সটি সাত পাহাড়ের শহর ইস্তানবুলের তৃতীয় পাহাড়ের উপর নির্মিত। প্রায় গোটা ইস্তানবুলেরই ভিউ পাওয়া যায় এখান থেকে। একপাশে রয়েছে হালিছ অর্থাৎ গোল্ডেন হর্ন আরেকপাশে রয়েছে বসফরাস- যেটি পৃথক করেছে এশিয়া ইউরোপ দুই মহাদেশকে। মসজিদের পশ্চিম দিকে রয়েছে সুলতান সুলায়মান এর মাজার , তার স্ত্রী হুররাম সুলতান এর মাজারসহ আরো কিছু ব্যাক্তিবর্গের মাজার। সুলতান সুলায়মান তার সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ঘোড়ার পিঠে। অর্ধেক ইউরোপ দখল করে ফেলেছিলেন তিনি। জীবনের শেষ সময়টাও ছিলেন সফর অভিযানে, ৭১ বছর বয়সে। হাঙ্গেরি এর যিয়্যেতভার দুর্গে অভিযান চলাকালীন তাঁবুতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ঐখানে শরীরের ভিতরের অর্গানগুলো( হার্ট, লিভার) এসব দাফন করা হয় আর দেহ ৮২ দিনে ইস্তানবুলে এনে এখানে দাফন করা হয়। সুলতান সুলায়মান ওসমানী সম্রাজ্যে ৯ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বিস্তার করেন যা বর্তমান ১১ টি তুরস্কের সমান। এর পাশাপাশি তার আরেকটা দিকও রয়েছে। ওসমানী সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কবিতা গজল দিভান তার লেখা। প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি গজল আছে তার। তার পাশে যার মাজার সে হলো তার স্ত্রী হুররেম সুলতান। সুলতান সুলায়মানের আগে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। দারুল কুড়া এর পাশে দাফনের ইচ্ছা পোষণ করেন যেন ছাত্রদের কুরআন পাঠের সাওয়াব পান তিনি । অনেক দান, সেবামূলক কাজ রয়েছে তার। মক্কা, জেরুজালেমে ,ইস্তানবুলের বিভিন্ন জায়গায় তার তৈরী অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেখতে পাই আমরা। সুলায়মানি জমিকে যদি এক আর্ট ধরেন তাহলে এই আর্ট ক্যানভাসের কেনারায় আর্টিস্ট এর স্বাক্ষর থাকা দরকার। স্বাক্ষর সুলায়মানি কমপ্লেক্সের বাম কোনায় শায়িত সে, মিমার সিনান । সুলতান সুলায়মানের ইচ্ছা ছিল তার মাজার সুলায়মানি এর ভিতরে হোক কিন্তু তিনি রাজি হন নি। এখানেই তার সাদাসিধে মাজার হোক চেয়েছিলেন তিনি। নিজে তিন মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত সাম্রাজ্য ওসমানী সাম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি হওয়া সত্ত্বেও ডকুমেন্ট গুলোতে তার সাক্ষর হিসেবে ব্যবহৃত মুহরে কি লেখা ছিল জানেন ? আল ফকিরুল হাকির আস সিনান। অর্থাৎ ফকির সিনান।
শেষ করবো সুলায়মানি উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সুন্দর এক কাহিনী দিয়ে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজির সম্রাজ্যের বড় বড় পাশা ,আলেম ওলামা সহ সাধারণ মানুষজন। সেই সময়ে তো আর ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হতো না , চাবি দিয়ে মসজিদের বাইরের গেট টা খোলা হতো। সুলতান সুলায়মান তার ওলামাদের জিজ্ঞেস করলেন , এই মসজিদ উদ্ভোধন কার দ্বারা শোভা পায় ? ওলামারা , পাশারা এইটা বলেনি যে অবশ্যই আপনার শোভা পায়। তারা বলেছিলেন, মিমার সিনানের শোভা পায় এর উদ্ভোধন করা। সুলতান সুলায়মান মিমার সিনানকে উদ্ভোধন করতে বললেন। মিমার সিনান মহান আল্লাহ তাআলা এর পবিত্র নাম আল ফাত্তাহ অর্থাৎ উন্মুক্তকারী বলে দরজা খুললেন সুলায়মানি মসজিদের।